
Table of Contents
সপ্তাঙ্গ নীতি
প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন কৌটিল্য বা চাণক্য। (375-283 BCE)। তিনি ছিলেন রাজা চন্দ্র গুপ্তের মহামন্ত্রী ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতা। তার বিখ্যাত গ্রন্থটি হল অর্থশাস্ত্র।
কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রকে একটি আঙ্গিক সংস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। কৌটিল্যের রাষ্ট্রপরিচালনার বিদ্যার অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব। চাণক্যের মতে রাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গ রয়েছে এবং এরা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখলে এগুলি মূল্যহীন। রাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গের বর্ণনা নিম্নে আলোচনা করা হল যা সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব নামে পরিচিত—

স্বামী :
- স্বামী বলতে বোঝায় প্রধান বা প্রভু। স্বভাবতই স্বামী বলতে রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপ্রধান কে বোঝায়। কৌটিল্যের মতে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রধান অঙ্গ হল রাজা বা স্বামী। রাজাকে উচ্চবংশজাত,সুভদ্র, সংস্কৃতিবান হতে হবে। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যের মন্তব্য কোন দুর্বল অথচ উচ্চবংশজাত রাজা অবশ্যই শক্তিশালী নিচু বংশ জাত রাজার থেকে শ্রেষ্ঠতর। রাজা, কাম, ক্রোধ, লিপ্সা, মোহ মুক্ত, সুসংগত সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও অর্থ শাস্ত্রের পন্ডিত হয়ে প্রজাদের মঙ্গলার্থে আত্মনিয়োগ করবেন। রাজা হলেন রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শক্তি।
আমত্য :
- চাণক্যের মতে আমত্য বলতে সুপ্রশিক্ষিত, সুসংগঠিত, সুদক্ষ প্রশাসন কর্মীদের বুঝিয়েছেন। আমত্যগন সকলকেই যোগ্যতা অনুসারে পদ অর্জন করতে হবে এবং প্রশাসনের নিযুক্ত হতে হবে। চাণক্যের মতে আমত্য গণের হাতে কৃষি উন্নয়ন, ভূখণ্ডের উন্নতি, দুঃখ কষ্ট দূর করা, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া ইত্যাদি দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি আরো বলেন যে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজার স্বেচ্ছাচারিতার কোন স্থান নেই।
জনপদ :
- জনপদ বলতে অর্থশাস্ত্রে জনগণ ও ভূখণ্ড কেই বুঝিয়েছেন। জনপদের থাকবে সুন্দর জলবায়ু ও গোচারণভূমি যেখানে কৃষকরা স্বল্প পরিশ্রমে শস্য উৎপাদন করতে পারবে। এছাড়া কৃষক শ্রেণী রাজস্ব ভার ও শাস্তি ভার বহন করবে এবং তারা হবে আনুগত্য প্রিয় এবং উৎপাদনকারী। কৌটিল্য জনপদের আয়তন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেননি তবে একটি গ্রামে 100 থেকে 500 পরিবার থাকবে এবং প্রতিটি স্থানীয় তে থাকবে অন্তত আটশত গ্রাম।
দুর্গ:
- কৌটিল্য রাষ্ট্রের অধিবাসীদের নিরাপত্তার কারণে রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ও চারিদিকে দুর্গ নির্মাণের কথা বলেছেন। দুর্গের আরেকটা নাম পুর। দুর্গ বলতে দুর্গ ও পুর দুটোকেই বোঝায়। আবার সংরক্ষিত রাজধানী কে দুর্গ বলে।
কোষ :
- সঠিক ও বৈধপথে রাজাকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে এবং এই ক্ষমতা রাজার হাতেই থাকবে। কোষাগার স্বর্ণ-রৌপ্য ও মূল্যবান অলঙ্কার ভর্তি থাকবে যেগুলি দুর্ভিক্ষের সময় ব্যবহার করা যাবে। কোষাগার পূর্ণ না হলে বৃহৎ সেনাবাহিনী রাখা যাবে না। আবার তিনি বলেন রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে মৌমাছির ন্যায় যেখানে ফুলের ক্ষতি না করে মধু সংগ্রহ করা হয় ঠিক তেমনি রাজস্ব দাতাদের ক্ষতি না করে রাজস্ব আদায় করতে হবে।
দন্ড :
- দন্ড হল বল প্রয়োগকারী শক্তি বা ক্ষমতা । তবে সেটা সেনাবাহিনীর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। সৈন্যবাহিনী হবে পুরুষানুক্রমিক, রাজভক্ত, শক্তিশালী এবং যুদ্ধে পারদর্শী। এছাড়াও রাজার আজ্ঞা দ্বিধাহীনভাবে মান্য করা হলো সেনাবাহিনীর মৌলিক কর্তব্য। তবে শূদ্র বলপ্রয়োগ কারী শক্তি হবে তা কৌটিল্য মেনে নিতে পারেননি।
মিত্র :
- রাষ্ট্রের শেষ উপাদান হলো মিত্র। মিত্রতা হবে বংশানুক্রমিক, অকৃত্রিম, উৎসাহদাতা ও আন্তরিক। তবে কৌটিল্য মিত্র বলতে যেমন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তিবর্গ কে বুঝিয়েছেন তেমনি পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সাহায্য কারী রাষ্ট্রকে মিত্র রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
সমালোচনা :
- চাণক্যের রাষ্ট্রপরিচালনার সপ্তাঙ্গ নীতিতে সমস্ত অঙ্গগুলোকে সমান গুরুত্ব দেননি।
- অনেকে চাণক্য কে গণতন্ত্রবিরোধী বলেও আখ্যায়িত করেন। কারণ তিনি রাজার হাতেই সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করেন।
- কৌটিল্য রাজাকে অপ্রতিরোধ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে স্বেচ্ছাচারিতার পথ প্রতিষ্ঠা করেন।
- দ্বিধাহীন আনুগত্য ছিল চাণক্যের সপ্তাঙ্গ নীতির মূল কথা। যা কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়।
- চাণক্য শূদ্র জাতিকে সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণের উপযুক্ত মনে করতেন না যা তার স্ববিরোধিতা কে সমর্থন করে। তিনি জাতপাত কে যোগ্যতার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন।
উপসংহার :
- উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উপসংহারে বলা যায় যে কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে না হলেও তিনি ছিলেন প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সার্বভৌমিকতা ও রাজার ক্ষমতাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এক কথায় বলা যায় প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, ম্যাকিয়াভেলি রা রাষ্ট্রের সঠিক উপাদান ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারেননি যা কৌটিল্য সুবিন্যাস্ত ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
2 thoughts on “Saptanga Niti / কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ নীতি”