উদারনীতিবাদের মূল নীতি বা বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো I

উদারনীতিবাদের মূল নীতি

 উদারনীতিবাদের মূল নীতি বা বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের সবথেকে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল উদারনীতিবাদ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি যে রাজনৈতিক আদর্শকে হাতিয়ার করে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয় তাহা হলো উদারনীতিবাদ। জন লক, মিল, গ্রীন, বেন্থাম, লাস্কি , বারকার ইত্যাদি হলেন এই উদারনীতিবাদ এর অন্যতম সমর্থক। 

উদারনীতিবাদের মূল নীতি : 

রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য :

  1. উদারনীতিবাদের মূল নীতি হলো রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। যেমন জীবনের অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার, ধর্মের অধিকার , নির্বাচন ও নির্বাচিত করার অধিকার ইত্যাদি ।

শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন :

  1. উদারনীতিবাদ বৈপ্লবিক উপায় রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের বিরোধী। শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে সংস্কারের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে আস্থাশীল।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা :

  1. উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে নাগরিকদের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ জোর দেয়। তাছাড়া নিরপেক্ষ আদালতের উপস্থিতিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার :
  1. উদারনীতিবাদ যেহেতু জনগণের শাসন তাই রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হবে ।
দলীয় ব্যবস্থায় আস্থা :
  1. উদারনীতিবাদ সরকার গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলে। 
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার :
  1. উদারনীতিবাদের মূল নীতি হলো নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার কে রক্ষা করা। তবে এই অধিকার অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়I

  1. অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : উপরিক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ছাড়াও নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন, স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার, সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা, আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য হলো উদারনীতিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

উপসংহার : বর্তমানে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে উদারনীতিবাদ ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। এবং সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের কার্যক্ষেত্রের পরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে এই উদারনীতিবাদ অর্থনৈতিক সাম্যে কে উপেক্ষা কড়ায় মার্কসবাদীরা এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। তারা মনে করেন সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তথাপি বলা যায় উদারনীতিবাদ হলো বিশ্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাস্ট্র মতবাদ।

মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো

karl marks state theory

                        

 মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো

ভূমিকা :

  • রাষ্ট্রের উৎস, প্রকৃতি,রাষ্ট্র ক্ষমতা ও তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রশ্নে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যে বিভিন্ন মতামত এর সন্ধান পাওয়া যায় তাদের সাধারন বক্তব্য অনুযায়ী ব্যক্তি ও সমাজের জন্য রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাল মার্কস ও এঙ্গেলস রাষ্ট্রকে একটি সম্পূর্ণ অভিনব দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেন এবং প্রচলিত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন। মার্কসের দৃষ্টিতে রাস্ট্র মানুষের কল্যাণ সাধন কারী কোন শুভ প্রতিষ্ঠান নয় । এটি উৎপাদনের উপকরণ এর সাথে যুক্ত মালিকদের দ্বারা গঠিত সম্পত্তি রক্ষা ও সাধারণ মানুষের উপর শোষণ চালাবার একটি অভিনব যন্ত্র মাত্র। নিম্নে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো—————-

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় ধারনা              

                                                                                                                                    মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে এঙ্গেলস তার বিখ্যাত গ্রন্থ The origin of family private property and the state নামক গ্রন্থে বলেন, আদি অনন্তকাল থেকে রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা এবং এমন সমাজ ছিল যেগুলি রাষ্ট্র ছাড়া চলতো। এককথায় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ক্ষমতার কোনো ধারণা সেই সময় ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের এক বিশেষ স্তরে যখন অনিবার্যভাবে শ্রেণীবিভাজন এল তখন এই বিভাজনের জন্যই রাস্ট্র প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অস্তিত্ব না থাকায় সেই সমাজে শ্রেণি বা শ্রেণি শোষণ বা শ্রেণী সংঘর্ষ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী দাস যুগে সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব, পণ্যসামগ্রীর বিনিময় ও লেনদেন প্রবর্তনের ফলে সমাজ জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা যায়। সমাজের দাস প্রভুগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে এবং সম্পত্তিহীন দাস গণ প্রভুর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এভাবে সমাজের দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং দাস মালিক ও ভূমি দাস গণ ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের অংশীদার হিসেবে শ্রেণীসংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এই সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সম্পত্তিবান শ্রেণি তথা দাস প্রভুগণ তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বজায় রাখার জন্য এবং সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুভব করে। আর এই প্রয়োজনের তাগিদেই সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসের ধারণা :   

 রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কস এঙ্গেলস এর দৃষ্টিভঙ্গি হল রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের যন্ত্র এবং বলপ্রয়োগের বিশেষ হাতিয়ার। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং উৎপাদনের উপকরনের প্রধান মালিক শ্রেণী শোষণ বজায় রাখার জন্য এই যন্ত্রটি কে ব্যবহার করে। সময়ের বিবর্তনে র সাথে সাথে এই যন্ত্র ও বিবর্তিত হয়েছে। দাস সমাজে ভূমি দাসদের শোষণ করার জন্য দাস মালিকদের স্বার্থে কাজ করেছে। সামন্ত সমাজে সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য কৃষক ও ভূমি দাসদের উপর শোষণ চালিয়েছে। বর্তমান সমাজে এ রাষ্ট্রনামক যন্ত্রটি পুঁজিবাদীদের স্বার্থে তথা বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে শ্রমিক, কৃষক তথা সর্বহারা শ্রেণীর ন্যায় সঙ্গত পাওনা বা উদ্বৃত্ত মূল্য কে আত্মসাত করেছে। সুতরাং রাষ্ট্র হল শ্রেণী শোষণের একটি বিশেষ যন্ত্র যা শুধুমাত্র ক্ষমতাবান শ্রেণি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে।মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো.

 মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো
সমাজতান্ত্রিক সমাজের রাষ্ট্রের প্রকৃতি :
সমালোচনা : 

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বিষয়ক তত্ত্বটি বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দ্বারা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে । যথা ——–

  1. কাল মার্কস রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিবর্তনে অর্থনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন।
  2.  রাষ্ট্রের উৎপত্তি ক্ষেত্রে অর্থনীতি ছাড়াও ধর্ম, সমাজ ,বংশ ,যুদ্ধ ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
  3. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কাল প্রপার বলেন ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় রাষ্ট্র শুধু শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস নয়, শ্রেণি সমঝোতার বটে। মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো
  4. কাল মার্কস রাষ্ট্রের জনকল্যাণ কারী দিকটিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন।মার্কসের রাষ্ট্রের অবলুপ্তি সম্পর্কে ধারণা এই মতবাদকে কাল্পনিক মতবাদের পরিণত করেছে।
  • উপসংহার :
  • উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা উপসংহারে বলতে পারি যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল না হলেও এই মতবাদ যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কারণ এই তত্ত্ব টি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠা ও ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত। মার্কসীয় রাষ্ট্র তত্ত্বটি আলোচনা করো

— —————————————————–

The Systems Theory of David Easton

The Systems Theory of David Easton

                       

The Systems Theory of David Easton

 The Systems Theory of David Easton

আধুনিক রাজনীতির পর্যালোচনায় ক্ষেত্রে ব্যবস্থা জ্ঞাপক তত্ত্বের সূত্রপাত করেন অন্যতম আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ইস্টন। জীববিজ্ঞানী Ludwig von bertalanffy জীবদেহের ব্যবস্থার ধারণাটি কে প্রথম প্রয়োগ করেন। ব্যবস্থার এই ধারণাকে ম্যালিগনোস্কি প্রমুখ নৃতত্ত্বে, ট্যালকট পারসন্স সমাজতত্ত্বের প্রয়োগ করেন। ডেভিড ইস্টন তার Political System (1953) নামক গ্রন্থে এই তত্ত্বটি কে রাজনীতি বিশ্লেষণ এর ব্যবহার করেন।

Table of Contents

          ইস্টন যে মৌল অনুমান কে সামনে রেখে তার ব্যবস্থা জ্ঞাপক তত্ত্বটি কে শুরু করেছিলেন তা হল কিভাবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন একটি পরিবেশে তার অস্তিত্ব বজায় রাখে যেখানে স্থিতিশীলতা ও পরিবর্তনশীল উভয়ই বিদ্যমান। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এর মূল প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থায়ী পরিবেশে এবং পরিবর্তনশীল জগতে– উভয়ের কিভাবে ক্রিয়াশীল থাকে এবং স্থায়ীত্ব লাভ করে।

         রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীলতা কে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইস্টন অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতিতে এমন একটি সাধারন তত্থ্য গড়ে তুলতে চেয়েছেন যার মাধ্যমে স্থানীয় /আঞ্চলিক ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক যে কোন স্তরের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ডেভিড ইস্টনের মতে, মূল্যের কর্তৃত্ব মূলক বরাদ্দই হলো যে কোন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল বিষয়। মানুষ এই বন্টন ব্যবস্থা কে মেনে নেয় ভীতিমূলক ,অজ্ঞান মূলক বা প্রথাগত কারণে। উল্লেখ্য যে যে কোনোভাবেই তা গ্রহণ করা হোক না কেন এটি সরাসরি সমাজের মিথস্ক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে। এই মিথস্ক্রিয়া গুলিকেই রাজনীতির মূল একক হিসাবে উল্লেখ করেছেন ডেভিড ইস্টন।

         ডেভিড ইস্টন এর মতে কোন সমাজের সেইসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা যার মাধ্যমে মূল্যের কর্তৃত্ব মূলক বন্টন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত ও প্রযুক্ত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার তিনটি আবশ্যিক উপাদান রয়েছে। যথা রাজনৈতিক সমাজ, শাসন প্রণালী এবং কর্তৃত্ব।

  • রাজনৈতিক সমাজ :
    • রাজনৈতিক কার্যকলাপের শ্রমবিভাজন এর ফলশ্রুতিতে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী সমূহ যারা বিভিন্ন প্রকার সমস্যা সমাধানের সময় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করে থাকে। 
  • শাসন প্রণালী :
    • শাসন প্রণালী বলতে বোঝায় সেইসব লিখিত ও অলিখিত নিয়মাবলী, রীতিনীতি , আদর্শ ও মূল্যবোধ কে বোঝায় যার উপর রাজনৈতিক কাঠামো টি নির্ভরশীল থাকে।
  • রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ :
    • এই কর্তৃপক্ষ হলো সেই সব ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি যারা ক্ষমতার অবস্থান থেকে মূল্য কর্তৃত্ব সম্পন্ন বন্টন এর সিদ্ধান্তসমূহ কে গ্রহণ করে এবং বাধ্যতামূলকভাবে তা প্রয়োগ করে।

উপরিউক্ত চিত্রটি কে বিশ্লেষণ করলে ডেভিড ইস্টন এর ব্যবস্থা জ্ঞাপক মডেলটির কতগুলি মৌলিক দিক আলোচনা করা যায়।

ডেভিড ইস্টন এর মতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি উন্মুক্ত ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা যে সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে তার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিরন্তন মিথস্ক্রিয়া চলে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়াও সমাজের অন্যান্য যেসকল উপব্যবস্থা থাকে তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবেশ। ইস্টন প্রকৃতিগতভাবে এই পরিবেশকে দুইভাগে ভাগ করেছেন । যথা আন্ত সামাজিক পরিবেশবাহ্য সামাজিক পরিবেশ

The Systems Theory of David Easton
  1. আন্ত সামাজিক পরিবেশ :
    • সমাজ অভ্যন্তরস্থ আচরণ, ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক , অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মিথস্ক্রিয়ার ফলে গড়ে ওঠে বাহ্য সামাজিক পরিবেশ।
  2. বাহ্য সামাজিক পরিবেশ :
    • রাষ্ট্রীয় সমাজের বাইরে যে সমস্ত ব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলি কে নিয়ে গড়ে ওঠে বাহ্য সামাজিক পরিবেশ। যেমন একটি রাষ্ট্রের বাহ্যিক পরিবেশ হল UNO,IMF, WTO ইত্যাদি।
  •  রাজনৈতিক ব্যবস্থা :
    • ডেভিড ইস্টন এর মতে , রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এমন কতগুলি উপাদান ও প্রক্রিয়া আছে যার মাধ্যমে পরিবেশের যে কোন প্রকার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে থাকে এবং তার পূর্ববর্তী ভারসাম্য অবস্থাকে বজায় রাখতে পারে। শুধু তাই নয় পরিবেশের যে কোন প্রকার পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মানিয়ে চলে এবং স্থায়িত্ব দান করে।
  • উপকরণ :
    • রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছে সমাজ ও পরিবেশ থেকে যে সমস্ত দাবি বা চাহিদার সৃষ্টি হয় সেগুলোর সাথে সমর্থন যুক্ত হলে তাকে উপকরণ বা Input demand বলে।
  • উপপাদ :
    • যে সমস্ত উপকরণ গুলি দাবি বা চাহিদা ও সমর্থন এর সাহায্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে সেগুলি থেকে ঝাড়াই-বাছাই করে মূল্যের কর্তৃত্ব মূলক বন্টন এর মাধ্যমে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজে প্রযুক্ত হয় তা উপপাদ নামে পরিচিত।
  • তথ্য ও অভিজ্ঞতা প্রেরক :
    • ইস্টন এর মতে উপকরণ গুলি কে উপপাদে পরিণত হওয়ার পর সেগুলিকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি-দাওয়া সমূহকে কতটা পূরণ করতে পারছে, গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলি সমাজের ইতিবাচক বা নেতিবাচক কি প্রভাব ফেলছে প্রভৃতি সম্পর্কিত তথ্য ও সংবাদ গুলি পাওয়া একান্ত জরুরী।

   রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বা উপপাদ্ গুলি তথ্য ও সংবাদ প্রেরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছে পুনরায় নতুন রূপে ফিরে আসে এবং সেগুলি পুনরায় দাবি ও সমর্থন এর সাহায্যে উপকরণের আকারে রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিকট উত্থাপিত হয়। ইস্টন এর মতে এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতার জন্য রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে বা নির্ধারিত কর্মসূচী সমূহের পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে। 

  • চাপ বা সংকট :
    • ডেভিড ইস্টন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চাপ বা সংকট মোকাবেলা করার কথা বলেছেন। তার মতি এর চাপ বা সংকট গুলি দুই ধরনের। যথা অতিরিক্ত দাবি জনিত চাপ এবং সমর্থনের হ্রাস জনিত চাপ।
  • অতিরিক্ত দাবি জনিত চাপ :
    • অতিরিক্ত দাবি জনিত চাপ গুলি কে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্গের দাবি পূরণ করতে অসমর্থ হয় তাহলে তা সংকট আকারে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছে উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি গুলির মধ্যে কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় তা ঝাড়াই-বাছাই কাজে অস্বাভাবিক বিলম্ব হলে সেটি সংকট আকারে উদ্বুদ্ধ হয়।

সমর্থন জনিত চাপ সমর্থন জড়িত চাপ কে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে যথা

  1. রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি দীর্ঘকাল ধরে তার সদস্যদের একটি বড় অংশের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারে, তাহলে তারা অসন্তুষ্ট হয়ে ব্যবস্থার প্রতি আংশিক বা সম্পূর্ণ সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
  2. রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অভ্যন্তরস্থ রাজনৈতিক প্রভাবশালী দলের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি সৃষ্টি হলে তা ব্যবস্থার প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রটিকে দুর্বল করে।
  3. উপকরণ গুলি কে filter of funnel এ প্রক্রিয়ায় ঝাড়াই-বাছাই এর কাজে যে সমস্ত দ্বার রক্ষীরা কাজ করে যথা রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টি হয়।
সমালোচনা :—
  •      
  1. ডেভিড ইস্টন এই পদ্ধতির সাহায্যে রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। কারণ পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে এখানে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
  2. কি কি কারণে সংকট সৃষ্টি হয় এবং কিভাবে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংকট প্রতিহত করা যায় সে সম্পর্কেও কোন বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।
  3. রাজনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন উপ ব্যবস্থায় বিশেষত শিল্প ব্যবস্থার কার্যাবলী, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি।
  4. মার্কসবাদীদের মতে , রাজনৈতিক তত্ত্ব টি কে রক্ষণশীল তথ্যমূলক একটি মার্কিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তথা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রচনা করেছেন।
উপসংহার –
    • ডেভিড ইস্টনএর ব্যবস্থা জ্ঞাপক তত্তও টিকে নানাভাবে সমালোচনা করা হলেও এই তত্ত্ব টি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ একটি কার্যকরী তত্ত্ব এবং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমাজে কিভাবে টিকে থাকে তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এই তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়। একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ থেকে কি কি চাপ আসতে পারে এবং তার কিভাবে সমাধান সম্ভব তার ব্যাখ্যা ও পাওয়া যায় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষনেও এই তত্ত্বটি কে প্রয়োগ করা যায়।

             ………………………………………….………………………………..

Plato Ideal state

Plato Ideal state

    

Plato Ideal state

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা আলোচনা কর :

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ভূমিকা :

প্রাচীন রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন Plato । তিনি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর সমগ্র চিন্তাভাবনাকে প্রতিফলিত করেছেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক কে তিনি ন্যায় ও আদর্শের প্রেক্ষিতে আলোচনা করেছেন। তিনি যে রাষ্ট্রের ধারণা দেন তা আদর্শ রাষ্ট্র চিন্তাভাবনা নামে পরিচিত তার চিন্তাভাবনাকে The Republic, The Statesman এবং তার আত্মজীবনী seventh letters এ খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন । নিম্নে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র চিন্তা ভাবনা আলোচনা করা হলো।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ও উদ্ভব :

প্লেটোর মতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। জীবনধারণের জন্য মানুষকে অসংখ্য প্রয়োজন মেটাতে হয় যা এককভাবে সম্ভব হয় না , স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সহযোগিতা উপর নির্ভর করতে হয়। এই ভাবেই পারস্পরিক নির্ভরতা ও আদান-প্রদানের ভিত্তিতেই যৌথ জীবনধারণের ফলে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের ।

রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মিলন :

আদর্শ রাষ্ট্র আলোচনার ক্ষেত্রে রাস্ট্র ও ব্যক্তির একত্র মিলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রকে মানবাত্মার ফল বলে মনে করতেন। এছাড়াও তিনি মনে করতেন মানুষের বিভিন্ন উপাদান রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয় । যথা যুক্তি, তেজ ও উদ্যম এবং কামনা বাসনা। এই গুণের প্রেক্ষিতেই তিনি রাষ্ট্রের উপাদানের শ্রেণীবিভাজন করেন। যথা:–

উৎপাদক শ্রেণী :

মানব জীবনের অসংখ্য চাহিদার মধ্যে তিনটি মৌলিক চাহিদা হল অন্ন ,বস্ত্র ও আশ্রয়। রাষ্ট্র জীবনের আদিপর্বে বিভিন্ন মানুষ এই মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে জড়িত ও কর্মরত ছিল। এইসব কর্মী মানুষের শ্রেণীগত পরিচয় হলো উৎপাদক শ্রেণী।

যোদ্ধা শ্রেণী :

রাষ্ট্রের কাজ মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তির নিবারণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাসস্থান ও অন্যান্য রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। এই কাজে প্লেটো রাষ্ট্রের মধ্যে তেজ বা উদ্যমী ব্যক্তিদের যোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করেছেন যাদের মধ্যে সাহস, শক্তি ও যুদ্ধ কৌশলে নৈপুণ্য থাকবে।

শাসকশ্রেণী:

রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে সামরিক দক্ষতা ছাড়াও জ্ঞান বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা বিশেষ প্রয়োজন। আর এই যোদ্ধা শ্রেণী থেকেই যুক্তি গুণের অধিকারী ব্যক্তিদের শাসকশ্রেণী হিসাবে বেছে নিয়েছেন রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে। যারা শারীরিক উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক উৎকর্ষের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করবেন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ও ন্যায় :

প্লেটো মনে করতেন আদর্শ রাষ্ট্রে ন্যায় কে প্রতিষ্ঠা করাই হল রাষ্ট্রের পরম ধর্ম। এবং এই ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে যখন সমাজের তিনটি শ্রেণী যথা উৎপাদনকারী শ্রেণি, যোদ্ধা শ্রেণী এবং শাসকশ্রেণী তাদের কর্তব্য অনুসারে নিজের নিজের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করবেন। 

শিক্ষা :

প্লেটো শাসকশ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি শাসকশ্রেণী যাতে সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে তার জন্য তিনি শিক্ষা, জ্ঞান ও কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে জীবন চর্চা করার কথা বলেন এবং দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা ব্যবস্থা উল্লেখ করেন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র সাম্যবাদ :

প্লেটোর রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সাম্যবাদ। যৌথ জীবনযাত্রা গ্রহণ এবং পরিবার প্রথা বর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন প্লেটো।

সমালোচনা : 

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনাকে অনেকে অবাস্তব বলে মনে করেন। কারণ যৌথ জীবন ব্যবস্থা এবং পরিবার প্রথা বর্জনকে কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এবং বাস্তবেও তা প্রয়োগযোগ্য নয়।

প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যক্তির কেবল জ্ঞানের ও গুণের কথা বলেছেন। ব্যক্তির রাষ্ট্র ছাড়াও অনেক স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে যা প্লেটো রাষ্ট্রতত্ত্বের উপেক্ষিত।

প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্ব গণতন্ত্রবিরোধী। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনায় রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেয়ে যুক্তিনির্ভর দার্শনিক কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।

প্লেটো সমাজের শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণি সংঘর্ষের বীজ বপন করেছেন। ফলে সমাজের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হতে পারে বলে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন।

গুরুত্ব: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হলেও এর গুরুত্ব কে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে তার চিন্তা-ভাবনা সমাজের ভাঙ্গন ও অস্থিরতাকে প্রশমিত করতে অনেকটাই সফল হয়েছিল। তাছাড়া ব্যক্তির নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সর্বোপরি প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে রাষ্ট্রচিন্তাভাবনা প্রসারিত হয়েছে ।

—————_—————————————————————-